তাইওয়ানের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য এবার কোনো আবেদন পড়েনি
ইতিহাস মানে পুরোনো ব্যাপার–স্যাপার আর শুধুই মুখস্থ বিদ্যা। অনেক লিখতে হয়, কিন্তু মেলে একেবারে কম নম্বর। ইতিহাস বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীসহ সবার মনেই এ ধারণা। যদিও ইতিহাসের গ্রাজুয়েটরা অনেক অজানা তথ্য জানার পাশাপাশি আকর্ষণীয় ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পান। আর্কাইভ–সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ, জাদুঘর, লাইব্রেরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিবিধ কাজের সুযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়ার পর লাইব্রেরি সায়েন্স, হিউম্যানিটি, সোশ্যাল সায়েন্সে স্নাতকোত্তর করার সুযোগ থাকে। কিন্তু এরপরই ইতিহাস বিষয় নিয়ে পড়াশোনায় এশিয়ার তরুণদের আগ্রহ কম। কারণটা কী, সেটাই খুঁজে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে।
সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য সংবাদ হলো, ইতিহাস নিয়ে যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে চান, তাঁদের কাছে তাইওয়ানের ন্যাশনাল চেং কুং ইউনিভার্সিটি পছন্দের শীর্ষে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, আগামী বছর বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাস বিভাগে অধ্যয়নের জন্য কোনো শিক্ষার্থী এবার আবেদন করেননি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টি তাইওয়ানের শীর্ষ তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের এমন প্রবণতার মূলে রয়েছে ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির ব্যাপ্তি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শিক্ষার্থীরা ইতিহাস বাদে বিজ্ঞান, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যাথেম্যাটিকসের মতো বিষয়গুলোতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের আগ্রহের বিষয়গুলোর প্রথম অক্ষর মিলিয়ে সংক্ষেপে বলা হয় স্টেম (STEM) এডুকেশন। উন্নত দেশগুলোর ভাবনা, ভবিষ্যতে তাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে স্টেম এডুকেশন প্রয়োজনীয় বিষয়।
যে-সব দেশ স্টেম এডুকেশনের ওপর জোর দেবে, তারাই ভবিষ্যতে এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। স্টেম এডুকেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জটিল সমস্যা সমাধানের মনোভাব ও দক্ষতা তৈরি হয়। বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁদের জানাশোনা তৈরি হয় এবং শিক্ষার্থীরা আবিষ্কারক ও উদ্ভাবক হয়ে উঠতে পারেন। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি ভারত ও চীনের মতো দেশও তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় স্টেমকে গুরুত্ব দিয়ে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। স্টেম এডুকেশনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও একুশ শতকের জন্য জনবল গড়ে তোলা।
স্টেম শিক্ষা কী?
মানুষের জীবনে সব জায়গায় আছে স্টেম শিক্ষার প্রভাব। যেমন বিজ্ঞান ছাড়া সভ্যতা অচল। জীবনের প্রতিটি জায়গায় বিজ্ঞানের প্রভাব। পাশাপাশি মানবসভ্যতায় প্রযুক্তি ক্রমবিকাশমান। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। একইভাবে প্রকৌশল ও গণিতও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই চার বিষয়কে সমন্বিতভাবে শেখার নামই হচ্ছে স্টেম শিক্ষা।
এ শিক্ষার মূল বিষয়গুলো হচ্ছে— সৃজনশীলতা, কোনো কিছু খুঁজে বের করার দক্ষতা, বিশ্লেষণ করা, টিমওয়ার্ক, যোগাযোগ, ডিজিটাল জ্ঞান ও সমস্যার সমাধান করা।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্টেম শিক্ষায় যাঁরা শিক্ষিত, তাঁদের জন্য প্রতিবছর ১৭ শতাংশ হারে কাজের সুযোগ বাড়ছে। আর অন্য ডিগ্রিধারীদের জন্য কর্মসংস্থান বাড়ছে প্রায় ১০ শতাংশ হারে। স্টেম শিক্ষা নতুন জিনিস উদ্ভাবন করতে শেখায়। ফলে বাজারে নতুন নতুন পণ্য ও সেবা আসে এবং ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। শেষ বিচারে দেশের অর্থনীতিতে সেটি অবদান রাখে।
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে জনসংখ্যার হার কমতে থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নানা সংকট দেখা দিয়েছে। ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে জাপানে ১৮ বছর বয়সীদের সংখ্যা কমছেই। তাইওয়ানে গত একদশকে স্নাতক সংখ্যা ২৫ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, তাকে দেশটির বিশেষজ্ঞরা ‘এনরোলমেন্ট ক্লিফ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। দেশটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০১০ সালের ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন থেকে গত বছর ৩ মিলিয়নে নেমে এসেছে।
শিক্ষার্থী ভর্তি কমে আসায় এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলোতে প্রভাব পড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। শিক্ষার্থীদের বিষয় পছন্দের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব দেখা গেছে। পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় অর্থনৈতিক সমস্যায় বেশি মুখোমুখি হওয়ায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতের মতো বিষয়গুলো বেছে নিচ্ছেন এখনকার শিক্ষার্থীরা। এর অন্যতম কারণ উচ্চ বেতনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দেয় এসব বিষয়ে পড়াশোনা। এ পরিবর্তন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের মতো দেশগুলোতে প্রভাবে ফেলেছে বেশি। কারণ, সেখানকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও শিক্ষকেরা টিউশন ফির ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। টিকে থাকার জন্য এসব দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের পছন্দের সঙ্গে বিভিন্ন কোর্সের সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ কোরিয়ায় জনসংখ্যা হ্রাস ও অর্থনৈতিক চাপের কারণে ২০০০ সাল থেকে ১৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সরকার পড়াশোনার বিষয় হিসেবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতের মতো বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর খাত ও অন্য উচ্চ প্রযুক্তি শিল্পে তরুণদের প্রস্তুত করার জন্য বিশেষভাবে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন একাডেমি চালু করেছে। একইভাবে জাপানে গত দুই বছরে ডিজিটাল ও গ্রিন (সবুজ) প্রযুক্তিতে দক্ষতা বিকাশে ১২৬টি প্রতিষ্ঠান সরকারি ভর্তুকির জন্য আবেদন করেছে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও পরিবেশগত স্থায়িত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষতায় এ অঞ্চলের যে কৌশলগত দৃষ্টি রয়েছে, এসব উদ্যোগ তারই প্রতিফলন।
পূর্ব এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে, যদিও এটি স্থানীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে আসার মতো সংকটকে পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত নয়। স্থানীয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ্রহ তৈরি এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানে নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ২০১২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যাকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছে।
সিঙ্গাপুরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে এলেও বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগের কারণে এখনো অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছেন। সিঙ্গাপুর সরকার বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতের মতো বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিলেও দেশের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণে সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়গুলোর গুরুত্বও স্বীকার করে। ফলস্বরূপ এ বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি বাড়ছে। তবে ইতিহাসের মতো বিষয়ে কারও আগ্রহ নেই।